৭৫ বছর বয়সে চলে গেলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান
গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ...... রাজিউন)।
তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ফুসফুসের জটিলতাসহ নানা ধরনের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামের বাড়িতে বাস করছিলেন দেশের অন্যতম এ ব্যবসায়ী। তিনি স্ত্রী, পুত্র, দুই কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মৃত্যুর পর রাজধানী ঢাকায় তার লাশ নিয়ে আসা হয়। গুলশানের আজাদ মসজিদে বাদ এশা জানাজার পর রাতেই বনানী কবরস্থানে লতিফুর রহমানকে দাফন করা হয়। চার বছর আগের এই দিনেই (১ জুলাই, ২০১৬) গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান তার নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন।
লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা শোক প্রকাশ করে পৃথক বার্তা দিয়েছেন; তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও ছিলেন তিনি। এবিসি রেডিও ও সাপ্তাহিক ২০০০-এর মূল মালিক প্রতিষ্ঠানও যথাক্রমে মিডিয়াস্টার ও মিডিয়াওয়ার্ল্ড ।
লতিফুর রহমানের জন্ম ভারতের পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়িতে ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট। তিনি ঢাকার গে-ারিয়ায় থাকতেন। পড়াশোনার শুরু সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে। সর্বশেষ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় ফিরে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত ডব্লিউ রহমান জুট মিলে ট্রেইনি হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৭২ সালে মিলটি জাতীয়করণ করা হয়। এটি ছিল রহমান পরিবারের অন্যতম আর্থিক খাত।
এর এক বছর পর ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন লতিফুর রহমান। বর্তমানে ১০ হাজার কর্মী নিয়োজিত আছে
এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আশির দশকে বাংলাদেশে নেসলের একমাত্র আমদানিকারক ও পরিবেশক ছিলেন লতিফুর রহমান।
নব্বইয়ের দশকে তিনি দেশে মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান স্মিথ, ক্লাইন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ নিয়ে আসেন, পরবর্তী সময়ে যা এসকেএফ নামে পরিচিতি পায়। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম ও সততার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে ব্যবসা খাতের নোবেল খ্যাত ‘বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ ২০০১ সালে তাকে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত করে। সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘সার্ক আউটস্ট্যান্ডিং লিডার’ সম্মাননাও পেয়েছেন। নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসায় অবদানের জন্য যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশিদের শীর্ষ ব্যবসায়িক সংগঠন ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্ট অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে।
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবসা কিনে নিয়ে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স ও বাংলাদেশ ল্যাম্পসের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে পিৎজা হাট, কেএফসি, পেপসিকোর স্থানীয় পার্টনার ট্রান্সকম।
কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনে নেতৃত্বদানকারী লতিফুর রহমান মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) সাতবারের এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের দুবারের সভাপতি ছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সহসভাপতি ছাড়াও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ চা অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন তিনি।
নেসলে বাংলাদেশ, হোলসিম বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল হাউজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করা লতিফুর রহমান লিনডে বাংলাদেশের (সাবেক ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানি) পরিচালক এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন।
স্ত্রী শাহনাজ রহমান, দুই মেয়ে সিমিন হোসেন ও শাজরেহ হক এবং ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে রেখে গেছেন লতিফুর রহমান। তাদের আরেক মেয়ে শাজনীন রহমান ১৯৯৮ সালে বাড়ির এক পরিচারকের হাতে খুন হন।
শোকবার্তা
স্বনামধন্য ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।
এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম শোক জানিয়েছেন।
শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে পৃথক শোকবার্তা পাঠিয়েছেন দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জাতীয় পার্টির (জেপি) পক্ষ থেকে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন দলটির চেয়ারম্যান ও বর্তমান সাংসদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব, চরমোনাই)। গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকেও গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
নতুনধারা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংগঠনটির চেয়ারম্যান মোমিন মেহেদী, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক শুভংকর দেবনাথ, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শান্তা ফারজানা, ভাইস চেয়ারম্যান চন্দন সেনগুপ্ত, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিপুন মিস্ত্রি প্রমুখ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।

No comments